ভয়

Scroll this

সার্কাসে যেসব হাতি খেলা দেখায় , তারা বিশাল দৈত্যাকার হলেও – শুধু একটা পাতলা দড়ি দিয়ে তাদের সামনের পা একটা লাঠির সাথে আটকানো থাকে। কোন চেইন নাই, কোন খাচা নাই। কোন সন্দেহ নাই যে, এই ঢাউশ সাইজের হাতি চাইলে যেকোন সময় দেদারসে এই দড়ি, লাঠি ভেঙ্গে পালিয়ে যেতে পারে । কিন্তু, তারা সেইটা করেনা। কিন্তু কেন ?

এই বিরাট হাতিগুলো যখন একদম শিশু থাকে তখন এদেরকে সার্কাস এর ট্রেইনিং এর জন্য আনা হয় । তখন, এই দড়ি আর লাঠিই যথেষ্ট শক্তিশালি থাকে বাচ্চা হাতিগুলোর জন্য। ছোটবেলায় তাই এরা এই বাঁধন ভাঙ্গার চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়, এবং তারা এই ভেবে বড় হয় যে তারা কখনই এই বাঁধন ভাঙতে পারবেনা। বড় হয়েও ওরা ভাবে যে এই দড়ির বাঁধন ওদেরকে বেধে রাখতে পারবে, তাই হাতি কখনও এই দড়ি ছিড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টাও করেনা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়।

হাতির মনে এই দড়ি নিয়ে একটা ভয় কাজ করে। এই ভয় হাতিকে একটা ব্যাসার্ধের মধ্যে আটকে রাখে সারা জীবন। তার এই ভয় , এই ব্যাসার্ধের গন্ডি – কিন্তু পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক ।
আমাদের মানুষের জীবন অনেকটা এই হাতির মতই কাটে । আমরা, আমাদের ভয় আর দুর্বলতাগুলোর কাছে কাবু হয়ে থাকি আজীবন । আমাদের লিমিটগুলো বরাবরই হয় আমাদের নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত । হাতি যেমন দড়ি ছেড়ার চেষ্টা করেনা কখনও, আমরাও আমাদের ভয়গুলোকে জয় করার চেষ্টা করিনা কখনও। আমরা, আমাদের ভয় এর দাসত্ব বরন করে নেই সারা জীবন এর জন্য ।

যে ভয় পায় কজন মানুষের সামনে কথা বলতে- সে সারা জীবনই নিজেকে সবার সামনে উপস্থাপন করা থেকে গুটিয়ে নেয় । যে rejection/ প্রত্যাখ্যান হওয়াকে ভয় পায়, সে সারা জীবনেও তার কাঙ্ক্ষিত চাকরিটিতে আবেদন করেনা , প্রিয় মানুষকে তার মনের কথা বলেনা । যে ‘পাছে লোকে বলে’ এরূপ বিদ্রুপকে ভয় পায়, সে কখনই সৃজনশীল কিছু তৈরি করেনা, সারাজীবনই অন্যকে খুশি করার জন্য কাজ করে যায়।
আমার খুব প্রিয় Stoic ফিলোসফার সেনেকা বলেছিল ঃ “We suffer more in imagination, than in reality “

Stoicism/Stoic philosophy গত বছর খানেক আমাকে অনেক অনুপ্রানিত করেছে, বিশেষ করে নিজের ভয়/ দুর্বলতা গুলো নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে । Stoic philosophy সম্পর্কে প্রথমে শুনি প্রিয় লেখক টিম ফেরিস(Tim Ferris) এর বই থেকে। টিম ফেরিস তার ভয় যেন তাকে কাবু করতে না পারে সেজন্য একটি বিশেষ অনুশীলন করেন প্রতি ৪ মাসে একবার। টিম ফেরিস সেটি শিখেছিলেন আরেক প্রাচীন Stoic philosopher , Epictetus এর বই থেকে। অনুশীলন টির নাম ‘Premeditatio Malorum’ যার ইংরেজি অর্থ ‘the premeditation of evils’
এই অনুশীলনে evil হচ্ছে আপনি যেটা ভয় পান এবং সবচেয়ে খারাপ কেসে যেটা ঘটতে পারে । এই অনুশীলনের তিনটি ধাপ।
প্রথম ধাপঃ আপনি সেই ভয়টাকে/সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিটাকে পরিষ্কার করে কাগজে লিখবেন। তারপর, আপনি অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন সেই পরিস্থিতিটাকে দেখতে, শুনতে, অনুভব করতে কেমন লাগবে। আপনি যদি এইটুকু করে থাকেন, তাহলেই আপনি অর্ধেক প্রস্তুত আপনার ভয়কে মোকাবেলা করতে। কারন, আপনার সবচেয়ে ভীত পরিস্থিতি যদি সত্যিই হয় সেটা আপনাকে বিস্মিত করবেনা । সেনেকা বলেছিল ঃ ” “The man who has anticipated the coming of troubles takes away their power when they arrive.”

দ্বিতীয় ধাপঃ প্রস্তুতি । সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য আপনি কী করতে পারেন? আপনার কাছে কী কোন বিকল্প অপশন আছে ? কীভাবে আপনি এটি হতে থামাতে পারেন? হলে আপনি কিভাবে Damage control করতে পারেন ? কীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবেন? এটি কাগজে লিখে রাখুন ।
তৃতীয় ধাপঃ প্র্যাকটিস করা । প্রথম দুধাপের পরে আপনাকে অবশ্যই প্র্যাকটিস করতে হবে। সাবেক রোমের রাজা , এবং একজন Stoic ফিলোসফার Marcus Aurelius এর কথা চিন্তা করুন, তিনি শীতে খালি পায়ে এবং ন্যূনতম পোশাক নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন । কেন? তিনি নিজেকে এমন একটি জীবনের জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন যাতে করে তার সমস্ত সাম্রাজ্য চলে গেলেও, দারিদ্র্যতে যেন তার কষ্ট না হয় । এবং এই সাধারণ অনুশীলনটি তাকে একটি অস্বাভাবিক শক্তি দিয়েছিল- কারন সে জানতো যে সে তার জীবনের সবচেয়ে worst case situation এর জন্যও প্রস্তুত ।

আমি প্রতিবছর অন্তত একবার করে হলেও এই ‘ ‘the premeditation of evils’ এর অনুশীলন করি । Computer Science and Engineering এর গ্র্যাজুয়েট হওয়া সত্ত্বেও আমি programming ভীষণ ভয় পেতাম। ব্যাপারটা লজ্জারও ছিল বটে আমার জন্য। তাই আমি প্রতিরাতে ঘুমাতে যাবার আগে একটা প্রোগ্রামিং প্রবলেম সল্ভ করে ঘুমাতে যেতাম ২০১৫,২০১৬ এই দুই বছরে।
ফলাফলঃ আমি দুই বছরে ১০০০+ প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধান করি। আর, আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমার সবচেয়ে বড় শক্তিতে পরিনত হয় ।
আমার মনে আছে, আমার প্রথম পাব্লিক স্পিকিং প্রতিযোগিতায় আমি থরথর করে কাপতেসিলাম ভয়ে । কলিজাটা একদম হাতে চলে আসবে ধকধক করতে করতে এই অবস্থা। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত বিতর্ক করতে করতে, মাইক ধরে দুটো কথা বলতে দেখি এখন আর ভয় লাগেনা একদমই ।
একজন সৌখিন যাদুশিল্পী হিসেবে প্রায় ১০ বছর+ ধরে শো করার পরও , এখনও কোন বড় স্টেজ ম্যাজিক শো করার আগে আমার obsessive compulsive disorder হয় , প্রচুর panic হয় । একটাই সমাধান সেই panic দূর করার, ৪০০-৫০০ বার সেই যাদু প্র্যাকটিস করা ।
Peter McWilliams এর একটি উক্তি আমার খুব প্রিয়ঃ
“To overcome a fear, here’s all you have to do: realize the fear is there, and do the action you fear anyway.”

বছরে একবার ঘটা করে এই কঠিন অনুশীলন বাদেও আমি দইনন্দিন জীবনের কিছু ছোট ছোট কাজেও fearlessness practice করার চেষ্টা করি। যেমনঃ
– ‘Rejection therapy’ , প্রতি সপ্তাহে এমন কিছু একটা করার চেষ্টা করা যেটাতে আমি সরাসরি রিজেকশন খেতে পারি ।
– আমার পরচিতমহলে কারও সাথে কোন অন্যায় হলে, সেইটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি ।
– নামাজ পড়ার চেষ্টা করি , আমি খেয়াল করেছি রেগুলার নামাজ পড়লে সেটা আমার মনে একরকমের স্থিরতা দেয়, অস্থিরতা আর ভয় দূর করে
Team Fearless চ্যানেল এর মিউজিক শুনি হেডফোনে আর workout করি। এটা বেশ হেলদি একটা আক্রমণাত্মক পাম্প নিয়ে আসে, যেটা personal record ছাড়িয়ে যেতে সহায়ক। আর, আমাদের ভয়কে বা লিমিটকে জয় করার জন্য কিছুটা পরিমান আগ্রাসি মনোভাব দরকার আছে ।

Fearlessness নিয়ে আমার যা জানা ছিল , পড়া ছিল সবই বললাম। একজন পাঠকেরও যদি এটা কাজে লাগে নিজেকে ধন্য মনে করব। শেষ করব আমার গুরু Muhammad Ali এর একটা উক্তি দিয়ে

আমি প্রায় প্রত্যকদিন ই নিজেকে reminder দেই এই বলে “Suffer now and live the rest of your life as a champion”

Tags:

24 Comments

  1. সুন্দর লিখা দোস্ত, অনেকের কাজে লাগবে।

    • ধন্যবাদ ভাইয়া। Means a lot coming from you

  2. Great & didactic indeed!
    It will be very Useful for many newish performer In Sha Allah

  3. Very nicely written bhaia. I love the idea of rejection therapy. Will try that.

    • Best of luck for that. Rejection therapy is very powerful

  4. You are very inspiring vaia! This write-up is also fluent and useful.

    • Thank you Sayma. Humbled by the Very very kind words ^_^

  5. A good one. পড়ে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

  6. দারুন লাগলো পড়ে। সহজ ভাষায়, গভীর চিন্তার কথা লেখা।
    #চলুক

    • ধন্যবাদ অয়ন। তোমার গলায় গান আর হাতে উকুলেলে টাও চলুক প্রায়ই এই প্রত্যাশা ভাই

Submit a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *