বছর দুয়েক আগে ২০১৮ এর শুরুর দিকে – তখন অফিসে লাঞ্চ করছিলাম। খাওয়ার টেবিলে আমার প্রিয় বড় ভাই আর এক্স-বস তানজিল ভাই সবার উদ্যেশ্যে একটা প্রশ্ন করেছিলেন :
“আচ্ছা বলোতো, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ টা কি?”
তো সবাই এক একটা উত্তর দিলো , কেউ বললো , সত্য কথা বলা , কেউ বললো ছেলেমেয়ে মানুষ করা , আরও বহু মানুষ বহু কথা বললো ।
কারও কথায় সন্তুষ্ট না হয়ে ভাই মাথা নাড়তে নাড়তে বললো , “সবচেয়ে কঠিন কাজ হল হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়া : নিজের/অন্যের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করতে পারা । “
এই কথাটা কোথায় গিয়ে যেন আমার ভেতরে দাগ কাটলো ।
আসলেই কি চিন্তা-ভাবনা বদলানো এত কঠিন ? কেন এই ব্যাপারটা এত কঠিন ?
এই ব্যপারটা আমাকে প্রায় দুইবছর ধরে ভাবালো , এই ব্লগটা তারই ফলশ্রুতিতে লেখা । আমার চিন্তার পেছনের চিন্তা (metarationality) গুলো এই ব্লগে কিছুটা বোঝানোর চেষ্টা করব ।
ধরুন ,আপনাদের সামনে পেশ করলাম একজন বক্সার কে

এবং তারপর বললাম

আপনি হয়ত তখন স্বভাবতই জিজ্ঞেস করতে পারেন :

তখন আমি জবাব দিলামঃ

আপনি অপ্রস্তুত হয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন

আমি জবাব দিলাম

আপনি হয়ত অবাক হচ্ছেন, কি ব্যাপার এইরকম লেইম গল্প বলার কি মানে। এরকম তো কখনই হয়না । মজার ব্যাপার হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকমটাই হয় । কারন ছাড়া একজনকে সেরা boxer বলার মতই, আমরা আমাদের দেশকে , আমাদের পাড়া মহল্লাকে, আমাদের ভাষাকে , খেলায় কোন একটা দলকে, জন্মসুত্রে পাওয়া ধর্মকে বেশিরভাগ সময় না জেনে না বুঝেই সেরা বলে থাকি ।
Scientific thinking করতে চাইলে আমাদের আগে পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান থেকে একটা hypothesis/ অনুমান দাড়া করাতে হবে। অপরীক্ষিত যেকোন তত্ত্বই একটি অনুমান মাত্র। সেই অনুমানকে প্রচুর পরীক্ষা করতে হবে, এর বিপরীত মতগুলো বিবেচনায় নিয়ে সেই অনুমানকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে, যাচাই করতে হবে ।
সেই পরীক্ষায় উতরে গেলেই , আমরা একটা নতুন তত্ত্ব দাড়া করাতে পারবো ।

বক্সিং এর জগতে, বক্সিং রিংকে বলা যেতে পারে অনেকগুলো আইডিয়া/অনুমানের মার্কেটপ্লেস/ বাজার, একজন বক্সার বিশ্বসেরা এটি একটি আইডিয়া /অনুমান মাত্র । একটা বক্সিং ম্যাচ হচ্ছে সেই অনুমান প্রমানের একটি পরীক্ষা , আর প্রতিপক্ষ বক্সার হচ্ছে একটি বিরোধী মত । আসলেই কেউ বিশ্বসেরা বক্সার সেটা প্রমান করতে হলে , তাকে শত শত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে । তেমনি, যেকোন আইডিয়া কেউ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাকে সকল সম্ভাব্য সমালোচনা আর বিরোধী মতকে ভুল প্রমান করার মাধ্যমেই সেটা করতে হবে।

আপনার ধারনাগুলোর সত্যতা যাচাই এর লিটমাস পরীক্ষা হচ্ছে সেটাকে প্রচুর পরিমান বক্সিং, অর্থাৎ বিতর্ক/সমালোচনার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া । কিন্তু, প্রতিপক্ষের বজ্রমুষ্ঠির বক্সিং খাওয়া যেমন কঠিন, নিজের ধারনা/বিশ্বাস গুলোকে চ্যালেঞ্জ করাও কঠিন। শুধু কঠিনই না, আসলে মহাকঠিন ।
কনফার্মেশন বায়াস :
আমাদের ব্রেইন আসলে Scientific thinking এর পুরপুরিই , উল্টো ভাবে কাজ করে । একজন মানুষ যখন কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ বা মতধারা কিংবা নির্দিষ্ট কোনোকিছুতে বিশ্বাস করে থাকে, তখন তার মধ্যে একটা প্রবৃত্তি কাজ করে সেই মতবাদ বা বিশ্বাসের স্বপক্ষে প্রমাণ যোগাড় করার। এক্ষেত্রে, যেসব প্রমাণ বা নিদর্শন তার মতবাদ বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তা যত শক্তিশালী বা স্পষ্টই হোক না কেন, মানুষটি সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা সেটিকে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করে থাকে। অন্যদিকে তার বিশ্বাস বা মতবাদের অনুকূলে থাকা প্রমাণ বা নিদর্শন, তা যত দুর্বলই হোক না কেন, সেগুলোকে সে গুরুত্বসহকারে নিয়ে তার বিশ্বাস বা মতবাদকে আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে থাকে। এই প্রবণতাটিকে বলে ‘কনফার্মেশন বায়াস’(confirmation bias)।
সংক্ষেপে, “আপনি যা দেখতে চান বা আপনার মন যা দেখলে আরাম পাবে, আপনি তা-ই দেখতে পাবেন। যা দেখলে আপনার মন অস্বস্তিতে ভুগবে, সেটা আপনি এড়িয়ে যেতে চাইবেন বা দেখেও না দেখান ভান করবেন।” – এটাই কনফার্মেশন বায়াস।

কনফার্মেশন বায়াস ৩ ভাবে আমাদের প্রভাবিত করতে পারেঃ
১) আমরা কিভাবে তথ্য সন্ধান করিঃ
বড় বড় শিল্পপতিদের এক কিয়দংস climate change deny করে আসছে বহু দশক ধরেই । যত বড় বড় জার্নালেই climate change এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে গবেষণা বের হোক না কেন, তারা তাদের মতের সাথে মিলে এমন কিছু pseudo-scientific গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে যাবে। অর্থাৎ, তারা এমন তথ্যই শুধুমাত্র অনুসন্ধান করে যা তাদের মতকে চ্যালেঞ্জ করেনা ।
২)আমরা কিভাবে তথ্য কে বিশ্লেষণ করি
ক্যারিয়ারের শুরুতে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ৪ টি সাইন্টিফিক পেপার লিখেছিল, যা ফিজিক্স নিয়ে মানুষকে পুরোপুরি নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। কিন্তু, সাইন্টিফিক কমিউনিটির একটা বড় অংশ তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। এমনকি , gravitational waves নিয়ে লেখা তার গবেষণাপত্রটি একটি কনফারেন্সে প্রত্যাখ্যিত হয়েছিল যখন আইনস্টাইন তার ক্যারিয়ারের তুঙ্গে তখন। এর একটা বড় কারন , Confirmation bias. সাইন্টিফিক কমিউনিটির বিজ্ঞানীরা তাদের শেখা নিউটনিয়ান ফিজিক্স দিয়ে আইনস্টাইন এর তত্ত্বকে বুঝতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিলেন – তাই তারা এরকম তত্ত্ব সহজে মেনে নিতে পারেনি ।
৩)আমরা কিভাবে মনে রাখি :
একটি ক্লাসিক এক্সপেরিমেন্টে, প্রিন্সটন এবং ডার্টমাউথ শিক্ষার্থীদের দুটি স্কুলের মধ্যে একটি খেলা দেখানো হয়েছিল। এক্সপেরিমেন্টে শেষে, প্রিন্সটন শিক্ষার্থীরা ডার্টমাউথের করা ফাউলের কথা অনেক বেশি মনে রেখেছিল । এবং ডার্টমাউথ শিক্ষার্থীরা প্রিন্সটনের করা ফাউলের কথা অনেক বেশি মনে রেখেছিল ।
উভয় দলের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বাস করত যে তাদের স্কুলটি প্রতিপক্ষ থেকে ভাল। এবং তারা সেই ঘটনাগুলোই মনে রাখতে পেরেছিল যেগুলোতে তাদের স্কুলটিকে ভাল এবং বিপরীত স্কুলটিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দেখিয়েছিল।
কিন্তু এরকমটা কেন হয় ?
মনে রাখতে হবে লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে, আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু survival এর জন্য designed , নিরপেক্ষ/সত্য খুজে বের করার জন্য নয়। আমরা যখনই নতুন কোন মতামতের সম্মুখীন হই যা আমাদের আঁকড়ে ধরে থাকা বিশ্বাসগুলোর সাথে বিরোধিতাপূর্ণ , আমাদের মস্তিষ্ক সেটাকে আমাদের মানসিক ভারসাম্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে – এবং সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নতুন মতামত কে অগ্রাহ্য করে ।

আমাদের আশেপাশে আমাদের মস্তিষ্ক দিয়ে প্রসেস করার থেকে অনেক অনেক বেশি তথ্য আছে। মস্তিষ্ক তাই তার দ্রুত প্রসেসিং এর জন্য কিছু শর্টকাট ব্যবহার করে। কনফার্মেশন বায়াস হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক এর জন্য শর্টকাট । আমাদের ব্রেইন বরাবরই কম শক্তি ব্যয় করে কাজ করতে চায় বিধায় সে শর্টকাট এর পথে হাটে ।
তাছাড়া, বিবর্তনের কারনে আমাদের সমাজ-ব্যবস্থাও এমন যে একটা দলের বিশ্বাস এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আচরনগুলোকে দলের সদস্যদের পালন করাকে ভালো চোখে দেখা হয় , আর উল্টোটা দেখা হয় কটাক্ষের চোখে । সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘virtue signalling’।
সমষ্টিক গোত্র হিসেবে এটা একটা unifying factor হিসেবে কাজ করে , যা ঐতিহাসিক ভাবে আমাদের মানব জাতির টিকে থাকার পেছনে একটা বড় কারন। Yuval Harari তার sapiens বইয়ে এরকমই দাবি করেছিলেন যে, common myth এ বিশ্বাস করার কারনেই মানব সভ্যতা এত বড় হতে পেরেছে। তবে, মনে রাখতে হবে গোত্রের ক্ষেত্রে এটা একটা unifying factor হলেও, সেই একই জিনিস কিন্তু ব্যক্তি ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ/বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় ।
শুধু সেটা না- আমরা বন্ধু বানাই তাদের যারা আমাদের মতই চিন্তা করে, আমরা থাকতে পছন্দ করি সেই এলাকায় যারা আমাদের মতই, আমরা বিয়ে আমাদের মতই আরেকজন মানুষকে, আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি যে আমাদের মত চিন্তা করে এমন কোন নেতা কে , আমরা সোশাল মিডিয়াতে আমাদের মত মানুষদেরই ফলো করি – যার ফলে আমরা একটা echo chamber এর মধ্যে বাস করি । একই শব্দ একটা বধ্য কামরায় বারবার প্রতিধ্যনিত হবার মত ব্যাপার এটা। এই echo chamber এ মিডিয়া/সংবাদ মাধ্যম হল শুধুমাত্রই একটি confirmation তৈরির শিল্পকারখানা – আপনি যা শুনতে চান সেরকম কোন খবর পেলেই সেই মিডিয়া ফুলিয়ে ফাপিয়ে আপনার সামনে পরিবেশন করবে, যা শুনতে চাননা তা এড়িয়ে যাবে । আমরা তাই যতই মনে করি আমরা স্বতঃস্ফূর্ত / স্বাধীন মতামত দিচ্ছি না কেন … আমাদের মতামত এর একটা বড় অংশই কিন্তু নিয়ন্ত্রিত

এবং একটু উপর থেকে দেখলে আমাদের সবার মতামত প্রায় একইরকম- আমরা একটা puppet মাত্র , আর সকল puppet গুলো মিলে তৈরি হয় একটা দানবাকার পুতুল । কিছু কমন বিশ্বাস, কমন গল্প, কমন মিথ, কমন স্টেরিওটাইপ এই সবগুলো ছোট পুতুলকে আঠার মত আকরে ধরে রাখে – তৈরি করে সেই দানবাকার পুতুল । এই দানবের বেচে থাকার জন্য প্রয়োজন ছোট পুতুলগুলোর অভিন্নতা /uniformity । ছোট পুতুলগুলোর বৈচিত্র, দানবের জন্য হুমকি ।

আমাদের মস্তিষ্ক আর আমাদের সমাজ এমনভাবে ডিজাইনড যে আমাদের নিজেদের চিন্তাধারাকে মৌলিক ভাবে পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। আর, কনফার্মেশন বায়াস এর দুর্ভেদ্য জাল ভেদ করার মত কঠিন কাজ হয়ত আরেকটা হয়না ।
“আচ্ছা বলোতো, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ টা কি?” তানজিল ভাই এর সেই প্রশ্নের উত্তরটা আসলে ঠিক। আমরা যেভাবে চিন্তা করি, সেই মেন্টাল মডেলগুলোকে বদলানো আসলেই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ ।
References:
1) https://www.verywellmind.com/what-is-a-confirmation-bias-2795024
2) https://medium.com/behavior-design/confirmation-bias-why-you-make-terrible-life-choices-43fc6d6dcbe1
3) https://waitbutwhy.com/2019/10/idea-labs-echo-chambers.html
4) https://waitbutwhy.com/2019/09/thinking-ladder.html
5) https://explorable.com/selective-group-perception
6) https://roar.media/bangla/main/lifestyle/confirmation-bias-tendency-that-hampers-the-ability-of-neutral-and-accurate-thought/
Interesting and informative read. Good work, bhaia!
Thank you ridhita. Means a lot
Nice writing.
thank you so much
অসাধারণ
ধন্যবাদ কাউসার ^_^
বাংলায় এই থিওরীগুলো পড়তে খুব ভালো লাগলো। ইলাস্ট্রেশনগুলো সুন্দর হয়েছে।
ধন্যবাদ সুরাইয়া । বাংলায় সাইকোলজির কনসেপ্ট বুঝাতে গিয়ে আমারও কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে । ভালো লাগলো শুনে খুশি হলাম ।
“সবচেয়ে কঠিন কাজ হল হেদায়ত প্রাপ্ত হওয়া”- এই উক্তিটা অসাধারণ। পুরো লেখাটাও চৎমতকার। <3
ধন্যবাদ আলামিন ^_^
কাউকে হিদায়াত করা কতটুকু কঠিন
Level – 1: changing yourself
A) open up your mind to accept change.
Here comes Confirmation bias – first step to believe, and accept the change
B) Leave old habit or belief
C) Change yourself to the new behavior
Up to this, fight against your nafs/self (islam), goddess of destruction (hindu), Phoenix (Greek), or HBR (https://www.health.harvard.edu/mind-and-mood/why-behavior-change-is-hard-and-why-you-should-keep-trying) – everywhere it says you have to rage a war of complete destruction of your old self and it is one of the most difficult things to achieve.
Level 2: changing or guiding someone else
But above all of these, making this change to someone else’s life just makes the order of the complexity to exponential level.
Level-3: guiding someone else’s life to Right direction (হিদায়াত)
And finally, not only changing someone else’s life, but also ensuring that the direction is right – oh boy, this seems simply impossible. How can you confirm the direction you have chosen and pursuing for someone else is the right one, is the right path for that person? Humanly impossible.
Who did it last time – probably 4/5 persons in the total history of mankind.
Can you guess some names? Let’s see 🙂
Great Writing, Vaia!
Thank you brother !
অসাধারণ! ইউনিক লেখার স্টাইল ভাই আপনার।
ধন্যবাদ সাফির। আজকে তো আমার প্রিয় একজন লেখকের কাছ থেকে কমপ্লিমেন্ট পেয়ে গেলাম । মিনস আ লট
আমার বেশ ভালো লেগেছে। আপনার বয়স বুঝতেছি লেখা থেকে! প্রশ্ন আছে অনেক।
প্রশ্ন করতে পারেন নির্ভয়ে