মানুষের মনকে আমার পানির মত মনে হয়। যখন নদীর পানি অশান্ত থাকে, খরস্রোতা হয়- তখন নৌকা নোঙ্গর করা খুব কঠিন, ডুবসাঁতার দিলে এক হাত সামনেও দেখা যায়না । আর, ঐদিকে পানি শান্ত থাকলে, নদীতে স্রোত না থাকলে – অপরিপক্ব মাঝিও নৌকা নোঙ্গর করতে পারে , পানির নিচেও অনেকদুর পরিষ্কার দেখা যায়। মন শান্ত থাকলেও তেমন , সব ঝড়ঝাপটা সহজেই পাড়ি দেয়া যায়, মনের চোখ দিয়ে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় বোঝা যায় অনেক কিছু ।জীবনের বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি কখনই পাইনি, কোন বই এ , কোন কোর্সে/ ওয়ার্কশপে , কোন গুরুর কাছে – বা কখনও কোন কোলাহলে । অশান্ত মনে ৯৯ বার ভেবেও পাইনি কোন সমাধান । কিন্তু, চিন্তা করা বাদ দিয়ে – ঠান্ডা মাথায় একাকি হাটছি , বা ডাইরি লিখছি – কোথা থেকে যেন উত্তরগুলো চলে এসেছে আমার কাছে । আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার প্রশ্নের উত্তরগুলো কিন্তু কোন জনারণ্যে পায়নি, পেয়েছিল হেরা গুহায় , একান্ত নির্জনতা । গৌতম বুদ্ধ তার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে, একান্ত নির্জনতা ধ্যান করে নির্বাণ লাভ করেছিলেন- পেয়েছিলেন তার প্রশ্নের উত্তর। শ্রী চৈতন্য থেকে শুরু করে অতীশ দীপঙ্কর – পাহাড় ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন । চার্লস ডারউইন , গেলাপেগোস দ্বিপ থেকে আসার পর , প্রায় ২৫ বছর নিভৃতে থেকে, প্রকাশ করেছিলেন তার যুগান্তকারী Origin Of Species বইটি । আমার কাছে তাই আমার মনের স্থিরতা , নিজের ভাবনা চিন্তার জন্য একান্ত নিভৃত সময়- সহস্র কোটি টাকার থেকেও বেশি মুল্যবান । আমি আমার মনের স্থিরতার জন্য একটা রুটিন ফলো করি। আজকে আমি আমার রুটিনটা শেয়ার করছি, কোন একজন ব্যক্তিরও যদি কাজে আসে আমি খুব খুশি হব : ১) আমি প্রতিদিন ৭ ঘন্টা+ ঘুমানোর চেষ্টা করি । উইকেন্ডে ৮-৯ ঘন্টা পর্যন্তও ঘুমাই। কোনদিন ইমারজেন্সির কারনে ৭ ঘন্টা ঘুম না হলে, দিনে power nap নেই । আমি খেয়াল করেছি, কোনদিন মাত্র ৫-৬ ঘন্টা ঘুম হলে – পরের দিন আমার মন-মেজাজ অস্থির থাকে , কোন কাজেই ফোকাস করতে পারিনা । বিখ্যাত sleep scientist Matthew walker তার “why we sleep” বই এ বলেছে, ৭ ঘন্টার কম ঘুমে perfect physiology নিয়ে কাজ করতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় শূন্য পারসেন্ট । ২) আমি প্রতিদিন ১-১.৫ ঘন্টা হাটি । আমাদের অফিসের ৬ তালায় একটা খোলা ব্যালকনি আছে । লাঞ্চের পরপরই আমি প্রতিদিন সেই ব্যালকনিতে নিয়ম করে হাটি । অফিসে একটু আগে পৌঁছে গেলে , গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ হেটে তারপর অফিসে ঢুকি, ফেরার সময়ও ঠিক সময়ে বের হতে পারলে বেশ কিছুক্ষণ হেটে তারপর বাসায় ঢুকি । হাটা আমার কাছে একটা escape এর মত, অনেকটাই meditative/spiritual experience . হাটার সময়টায় আমি অতিতের আফসোস কিংবা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ভুলে যাই- স্পেস-টাইম চলে যায় ব্যাকসিটে , আমি শুধু টের পাই আমি ঐ মুহূর্তটাতে আছি । ৩) আমি সপ্তাহে ৩-৪ ঘন্টা নিজের ডাইরিতে লিখি । মনের আনাচে কানাচে জমে থাকা কতশত কথাগুলো অকপটে লিখে ফেলা একটা খুবই শক্তিশালী জিনিস । প্রিয়বন্ধুকে যেমন কষ্টের কথাগুলো বললে কষ্ট কমে- মনের কথাগুলো বললে হালকা লাগে – ডাইরিতে লেখা ব্যপারটাও আমার জন্য অনেকটা এরকম। এই লেখার মাধ্যমে আমি অসম্ভব চিন্তার স্বচ্ছতা পেয়েছি । ৪) আমি প্রতিদিন কিছু সময় আমার curiosity explore করি । যেসব ব্যপারে আমার অনেক curiosity , সেগুলো নিয়ে বই পড়লে, ব্লগ পড়লে , ঘাটাঘাটি করলে মন ঠান্ডা থাকে, ব্রেইন চাঙ্গা থাকে । গত কয়েকমাস পড়ছি physics নিয়ে , আইনস্টাইন আর রিচার্ড ফাইনমান এর কাজ নিয়ে । ৫) আমি নিজের সঙ্গ বেশ পছন্দ করতে শিখেছি। প্রায় সময়ই অফিস থেকে ঠিক সময়ে বের হতে পারলে , বাসার কাছে কিছুক্ষণ একটা ক্যাফে তে একা একা কফি খাই, আর বই পড়ি । লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলছি – জীবনের একটা বড় সময় social validation খুব পছন্দ করতাম । আমি বিতর্কের ফাইনালে স্পিচ দিবো , ম্যাজিক শো করবো- হাজার মানুষ শুনবে হাততালি দিবে, এইগুলো পছন্দ করতাম । পরে গিয়ে বুঝলাম, আমার হ্যাপিনেস যদি আরেকজন এর ভালোলাগার উপর নির্ভর করে , তাহলে আমার হ্যাপিনেস তো আসলে একটা তাসের ঘর । আরেকজন চাইলেই এইটা দুমরে মুচরে তখন ভেঙ্গে ফেলতে পারে। হ্যাপিনেস আসলে একটা ইন্টারনাল প্রসেস। যখন থেকে এই সত্য বুঝেছি, তখন থেকে একান্তে নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে শিখেছি । ৬) প্রতিদিন ৫ মিনিট মেডিটেশন করার চেষ্টা করি । এইটা মাঝেমাঝে মিস যায়। তবে , কোনদিন ঘুম আসতে মুশকিল হলে, কিংবা কোন ব্যপারে টেনশন থাকলে মেডিটেশন করলে বেশ রিলিভড লাগে, ঘুম আসে, টেনশন কমে যায়। আমি খেয়াল করেছি, নিয়মিত নামাজ পরলেও একইরকম প্রশান্তি কাজ করে। এই রুটিন পাথরে খোদাই করা না। এটা আমার জীবন আর লাইফস্টাইলের সাথে যায়। আমার স্যানিটির জন্য এই একান্ত সময়গুলো আমার খুব প্রয়োজন । আমার জীবনের noise গুলো থেকে signal কে আলাদা করার জন্য এই নিভৃত সময়গুলো খুব প্রয়োজন । “The answers you seek never come when the mind is busy, they come when the mind is still, when silence speaks loudest”- Leon Brown
Mahdi Mashrur Matin
Engineer.StoryTeller.Life Enthusiast