বিপ্লবী মেজো কাকা

Scroll this

সাল ১৯৭১। পরিবারের আদরের মেজো ছেলে আব্দুল জব্বার। নেত্রকোনা কলেজের ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে সদ্য গ্র্যাজুয়েট তিনি। হঠাত করেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ । ২৫শে মার্চ কালোরাত্রিতে ঘটে গেল শতাব্দীর ঘৃণ্যতম একটি গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-সারা দেশে তখন দাউ দাউ করে জলছে আগুনের লেলিহান শিখা ।

যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিনের মাথায় সে ভাবে, এহেন কাপুরুষের মত ঘরে বসে থেকে কালক্ষেপণের জন্য তার জন্ম হয়নাই। দেশ মাতৃকার টানে প্রতিশোধপারায়ণ জব্বার মার্চের শেষেই তার একদল দামাল বন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রনাধীন নেত্রকোনা অস্ত্রাগার লুট করে। নেত্রকনার আনসার বাহিনীর সহযোগিতায় এই লুটক্রিত অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে তিনি সুচনা ঘটান মুক্তি ট্রেনিং এর। মুক্তারপাড়া কলেজের মাঠে প্রায় একশ মুক্তিপাগল যুবককে প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষন দেয়া হয়। উদ্দেশ্যঃ গ্রাসরুট পর্যায়ে শত্রুর মোকাবেলায় একদম প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য মনে-প্রানে প্রস্তুত জব্বার । কিন্তু, মা-বাবাকে যুদ্ধ যাওয়ার কথা বললে হয়ত তারা রাজি হবেনা- এই ভেবে ,এক অন্ধকার রাতে বাসা থেকে পালিয়ে চলে যায় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। নিজ পরিবারের মায়া ত্যাগ করে শুরু হয় এক অনির্দিষ্ট দীর্ঘ যাত্রা। লক্ষ্য দেশ স্বাধীন করার,দেশকে শত্রু মুক্ত করার। ভারতের মেঘালয় প্রদেশের তুরা ট্রেনিং সেন্টারের মুক্তিজুদ্ধের সর্প্রবথম ব্যাচ হিসেবে সফলতার সাথে ট্রেনিং শেষ করেন তিনি। ট্রেনিংকালে তার নিপুন athleticism , বুনো শারীরিক-শক্তি আর স্ট্যামিনার পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের খুটিনাটি রপ্ত করার মাধ্যমে সে খুব অল্প সময়েই সবার নজর কারে। ফলে মাত্র ২৩ বছর বয়স আর non-military person হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেক্টর-১১ এর Deputy Company Commander এর দায়িত্ম অর্পণ করা হয় ।

প্রশিক্ষন শেষে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ‘জান দেব,তবু ছাড় দেবনা’ -এই মূলমন্ত্র নিয়ে মাটি কামড়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহগুলোতে লড়ে যাচ্ছিলেন তিনি ও তার দল। এক সম্মুখ যুদ্ধে দুই দিক থেকে হানাদার বাহিনি ফায়ার করায় সেইবার অনেক সহযোদ্ধা মারা যায় এবং তার অধিনায়ক গুরুতর আহত হয় । যুদ্ধের বাকি সময়টা তাই তাকে Company Commander এর ভুমিকায় সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। 
শত্রুপক্ষ যেন সেক্টর-১১ এ ঢুকতে না পারে এজন্য তিনি ঠিক করেন বারহাট্যা-মহনগঞ্জ এর connecting link ঠাকুরাকোনা ব্রিজ টি ধ্বংস করা জরুরি । 
১৩ জুলাই ১৯৭১ এ তার নেতৃত্বে কোম্পানির বিপ্লবী ট্রুপ নিয়ে বিশাল ঠাকুরাকোনা রেলওয়ে ব্রিজ টি গোলাবারুদ দিয়ে উরিয়ে দেয়। বিকট কেপে উঠে অত্র এলাকা। সড়ক ও রেলপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নেত্রকোনা। এলাকার ছেলে বিধায়, পুরা শহরে খুশির রব ছরিয়ে পরে – জব্বার তার বাহিনি নিয়ে এসে ব্রিজ গুড়িয়ে দিয়ে গেসে যেন হানাদারেরা আসতে না পারে। সবার মুখে শুধু জব্বার আর জব্বার। অন্যদিকে রাজাকারেরায় এই খবর পায় । ফলে, ২ দিনের মধ্যেই জব্বারের ভিটেবাড়িতে হানা দেয় পাকিস্তানি নেকড়ের দল, তবে জব্বার/ তার পরিবারের কাওকে পায়না। কারন, আগেরদিন রাতেই বাড়ির সবাই রওনা দেয় অন্যত্র । কাওকে না পেয়ে , ক্ষোভবশত, নেত্রকোনা সদরের কলেজরোডে তাদের পুরো বাড়ি আগুন দিয়ে পুরিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় হানাদার বাহিনি।

জব্বারের বিরত্মে অনুপ্রানিত হয়ে তার ছোটভাই আব্দুল মতিন , ভারতে প্রশিক্ষন শেষে সম্মুখ যুদ্ধে যোগদান করে। তার বড় ভাই আব্দুল মান্নান ও পরবর্তীতে যুদ্ধের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। আরও, ছোটভাই আব্দুল হাকিম যুদ্ধে সহকারি ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। একই পরিবার থেকে চার-চারটি মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। এর পিছনের সবচেয়ে বড় অনুঘটক ছিল জব্বার এর প্রথম যুদ্ধে জব্বারের সাফল্য আর বিরত্ম। শুধু পরিবার না, এলাকার বহু ছেলে তার শৌর্য-বীর্যে অনুপ্রানিত হয়ে রণাঙ্গনে যোগ দিয়েছিল।

অতঃপর, দেশ স্বাধীন হল । মায়ের কোলে ফেরত আসল বীর মুক্তিযোদ্ধা জব্বার ও তার যোদ্ধা ভাইয়েরা । ১৯৭৫ সালে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর,মুক্তিজুদ্ধের ইতিহাসকে বেআব্রু করার চক্রান্ত যখন দেশজুরে, তখন এই জব্বারের নামে ‘দেশদ্রোহী’ মামলা দায়ের করা হয়। এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড খাটতে হয় তাকে। জেল থেকে বের হওয়ার পর, বেশ কয়েকবছর দেশের বাইরে চাকরি নিয়ে থাকতে হয় থাকে। অতঃপর তিনি দেশে ফিরেন, পরবর্তী ৩৫ বছর অত্যন্ত সাদামাটা নির্মোহ জীবন যাপন করেন তিনি। পেশায় ব্যবসা করতেন, আর সময় পেলেই ছেলে-মেয়ে-ভাইস্তা-ভাইস্তি সবাইকে একাত্তরের গল্প শুনাতেন, দেশকে কে নিয়ে তার আশার গল্প শুনাতেন।

গল্পের এই আব্দুল জব্বার ছিলেন আমার আপন চাচা। আমি হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতমালা দেখিনি, তবে জব্বার কাকাকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিত্যের দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা হিমালয়ের মতোই। কী সাহস, কী প্রজ্ঞা, কী অসম্ভব দৃঢ়চেতা মনোবল।এই নিতান্তই প্রচারবিমুখ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা গত ১৩ অক্টোবর,২০১৫ এ বার্ধক্যজনিত কারনে ইন্তেকাল করেন ।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর।

“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণেও তাই তুমি করে গেলে দান”

মুক্তিযুদ্ধের এরকম অসংখ্য বীরের দুঃসাহসী সব অভিজানের গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের আশেপাশে। আসুন ছড়িয়ে দেই এসব কালোত্তীর্ণ গল্পগুলোকে। জেগে উঠুক আমাদের সবার ভেতরের বিপ্লবী জব্বার 

Tags:

Submit a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *