
পড়নে থাকত সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট । মুখে কালো ফ্রেমের চশমা। আর কণ্ঠ এত বলিষ্ঠ যে, তিনি যখন ১৮০ জনের ক্লাস নিতেন মাইকও লাগতোনা । একটা অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল তার । তিনি যখন কথা বলতেন, তখন ক্লাসে একটা শব্দও হতোনা । তন্ময় হয়ে শুনত সবাই । গণিত আর জীবন-দর্শন শিখিয়ে এই একটা লোক কত সহস্র মানুষকে আলোকিত করেছে তার হিসাব নাই । নটরডেম কলেজের এযাবতকালের সব ছাত্রের কাছে তিনি একজন কিংবদন্তি। তিনি হচ্ছেন , নটরডেমের গণিতের শিক্ষক জহরলাল সরকার।
আমার গনিতের প্রতি ভালোবাসা তৈরির পেছনের কারিগর ছিলেন , জহরলাল স্যার।
“The good teacher explains. The superior teacher demonstrates. The great teacher inspires”- এই উক্তির প্রকৃষ্টতম উদাহরণ হলেন স্যার । স্যার ছাত্রদের কি পরিমানে স্নেহ করতেন আর উৎসাহ দিতেন- সামান্য কটা শব্দে আসলে তা প্রকাশ করা যাবেনা । গণিতকে যখন তিনি ভেঙ্গেচুড়ে একদম fundamentals থেকে বুঝাতেন তখন ওনাকে মনে হয়ত স্বয়ং Euclid/Pythagoras , আর যখন তিনি জীবন-দর্শন নিয়ে কথা বলতেন তখন মনে হত স্বয়ং দালাই লামা বোধয় আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন। উনি যখন বোর্ডে লিখতেন, মনে হত variable আর equation গুলো যেন কথা বলছে, Geometry যখন ভেঙে ভেঙে একে বোঝাতেন তখন মনে হত যেন animation হচ্ছে geometrical-demonstration এর। গনিতের কোন জিনিসই যে মুখস্ত/টেকনিক-সর্বস্ব নয়, বরং পুরটাই যে বোঝার, আর সেই বঝাটা যে কত আনন্দের , কত রোমাঞ্চকর – জহরলাল স্যারের ক্লাস না পেলে বোধয় অজানাই থেকে যেত।
ওনার কাছ থেকে কি কি শিখেছি সেগুলো বলতে উপন্যাস হয়ে যাবে । তবে, স্যার এর কাছ থেকে শেখা ৩ টি লাইফ-লেসন এখানে তুলে ধরছি ঃ
১) Fundamentals থেকে চিন্তা করতে শেখা
স্যার শিখিয়েছিলেন যেকোন mathematical problem কেই দিব্বি সল্ভ করে ফেলা সম্ভব যদি আমরা Fundamentals থেকে চিন্তা করতে শিখি । না বুঝে গণিত করা, নোটবই দেখে গণিত করা কে স্যার ঘ্রিনা করতেন। স্যার বলতেন ঃ
“নোটবই হইল তোদের বোবা-স্যার, ঐ স্যারে দেখায়া দিবে ক্যামনে অঙ্ক করতে হয়, কিন্তু কিচ্ছু বুঝাবেনা । ঐ নোটবই দেইখা অঙ্ক করলে তোরাও হবি নোটবই এর মত জ্ঞান -প্রতিবন্ধী “
স্যারের এই কথা শুনে আমি ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে বাসার সবগুলো নোটবোই ফেলে দিসিলাম। কলেজের দুইবছর প্রতিটা অঙ্ক হাতে কলমে নিজে করার চেষ্টা করসিলাম । এই ছোট একটা সিদ্ধান্ত আমার পরবর্তী জীবনের অনেকগুলো ধাপ সহজ করে দিসিলো ।
স্যার বলতেন , যেটা তুমি কষ্ট করে ঠেকে ঠেকে বুঝে বুঝে শিখবা , সেইটা হচ্ছে তোমার অর্জন – এইটা কখনও তুমি ভুলবানা । আর যেইটা তুমি শর্টকাটে শিখবা , সেই জ্ঞান তোমার কর্পূরের মত উবে যাবে । এই জন্য স্যার যেকোনো চ্যাপ্টার শুরু করার আগে ৩ দিন তিনি শুধু theory আর fundamentals ই বুঝাতেন । প্রতিটা mathematical equation কে তিনি গ্রাফ এ visualize করা শিখিয়েছিলেন যেন আমরা বুঝতে পারি আসলে কি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে । স্যার বার বার বলতেন ঃ
“কী বলছি , কেন বলছি – তা জানতে হবে , বুঝতে হবে ।”
২) প্রশ্ন করতে শেখা
প্রতিদিন ক্লাসে এসে স্যার শুরুতেই বোর্ডে লিখতেন ঃ
কেন কি লিখি জানতে চাই?
তারপর পড়ানো শুরু করতেন। স্যার সবসময়ই আমাদের বোঝাতেন যে, জ্ঞানীরা প্রশ্ন করে , আর মূর্খরা সবকিছু জানার ভাব করে থাকে । স্যার আমাদেরকে সবসময় ”Beginners mind” এ থাকতে বলতেন , যেন আমরা সবসময়ই যেকোন নতুন কনসেপ্টকে কয়েকভাবে প্রশ্ন করতে শিখি।
তিনি বলতেন, আমরা প্রশ্ন করতে না শিখলে হাজার গোল্ডেন এপ্লাস পেলেও সেই শিক্ষা মূল্যহীন । স্যার মস্করা করে বলতেন , “তোদের ঐ গোল্ডেন চোরেও নিবেনা , মাছিতেও ধরবেনা ” যদিনা আমাদের মধ্যে জানার/প্রশ্ন করার নুন্যতম কৌতূহল না থাকে । বার বার শুধু বলতেন ঃ
প্রশ্ন করলে উত্তর পাবি , প্রশ্ন কর । তোরা জানিসনা এইটা পাপ না, জানতে চাসনা এইটা পাপ
৩) মূল্যবোধ ও জীবনদর্শন
স্যার এর সবচাইতে চমৎকার ব্যাপার ছিল তার জীবনদর্শন, তার values, তার ethics । ইস্পাতের মত কঠিন তার নীতি আবার পানির চেয়েও কোমল পিতৃসম আচরণ ছিল স্যার এর । ৩ যুগেরও বেশি সময় ধরে মহীরুহ হয়ে ছিলেন তার ছাত্রদের কাছে ।
স্যারকে একজন শিক্ষক বললে ভুল হবে, তিনি একাই একটি school of thought । তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি দেশকে ভালোবাসার কথা বলতেন, মাকে ভালোবাসার কথা বলতেন । তার ভাষায় ঃ
তোমার মায়ের থেকে কেউ তোমাকে বেশি ভালবাসেনা পৃথিবীতে । কেউ যদি বাসে তবে সে হয় ডাইনি , নয়ত তার কোন স্বার্থ আছে । মাকে ভালবাসবি সবসময়। মায়ের দোয়া হইল এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি
স্যার বলতেন সত্যিকারের জ্ঞানীরা বিনয়ী হয় । আর মূর্খরা হয় অহংকারী । তিনি বলতেন ঃ
বিদ্যা অর্জনীয় , তবে শিক্ষা আচরণীয়
তিনি সবসময় বলতেন , আমাদের প্রতিযোগিতা সবসময় আমাদের নিজেদের সাথেই , অন্য কারোর সাথে না । তাই ভালো করার স্প্রিহাটা হতে হবে “internal” । এই স্প্রিহা, এই সক্রিয়তা না থাকলে হাজার কোচিং , হাজার লবিইয়িং করেও লাভ হবেনা । স্যার এর ভাষায় ঃ
নিজের সক্রিয়তা না থাকলে কিচ্ছু করতে পারবিনা । চক্ষুর সাথে মনের সংযোগ না ঘটিলে মেধার বিকাশ ঘটে না

স্যার এর অবিশ্বাস্য রকমের work-ethics ছিল । এই বয়সেও তিনি ক্লাস নেয়ার আগে, প্রতিরাতে ১:৩০ টা পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন, লেকচার রেডি করতেন । অসম্ভব পরিমাণ পড়াশুনা করে এসে তিনি ক্লাস নিতেন। কোনদিন ক্লাস শেষে ওনার যদি মনে হত তিনি ঠিকভাবে বুঝাতে পারেননি , উনি সারারাত ছটফট করতেন। পরেরদিন আবার একই জিনিস পুনরায় পরাতেন , আরও নতুনভাবে বুঝানোর চেষ্টা করতেন । ওনার এত চেষ্টার পরও যখন ছাত্ররা ফাকি দিত , তখন তিনি বলতেন
“ তোরা যদি ঠিক মতো অংক না করস তবে হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ – এ আমারে জিঞ্জাসা করব ,‘কিরে,জহর ? তোর ছাত্ররা অংক পারে না কেন ?’
তখন আমি ওনাকে কী জবাব দিব বল ?”
আমি জানিনা একটা মানুষের পক্ষে এরকম মহৎ কিভাবে হওয়া সম্ভব ?
গতবছর(২০১৮) আমাদের বুয়েটে নটরডেমিয়ানদের এক ইফতার এর দাওয়াতে এসেছিলেন জহরলাল স্যার। বুয়েটের গেট দিয়ে ঢুকতেই শতশত ছাত্র হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্যার এর পা ছুয়ে সালাম করতেসিলো ।

অনেকের চোখে পানি চলে আসছিলো। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কলেজ শিক্ষক প্রবেশের পর এতটা সম্মান আর ভালবাসা পেতে পারে- সেটা আর কারো পক্ষে পাওয়া সম্ভব কিনা জানিনা। আমার মনে হয় বাংলাদেশের কোন মন্ত্রী এমপিও এমন অভিবাদন পায় নাই কখনও। এবং একার পক্ষে সবার শ্রদ্ধা, ভালবাসা, মন জয় করা সম্ভব না, এই কথাটার একমাত্র ব্যতিক্রম উদাহরণ হচ্ছেন স্যার।
গুরু আমাকে বুঝিয়েছিলেন গণিত কল্পনার বিজ্ঞান নয় ,ইহা দৃশ্যমান , অনুভব করা যায় । গুরু শিখিয়েছিলেন কিভাবে ভাল মানুষ হতে হয় । উনি কেবল গণিতের শিক্ষক ছিলেন তা নয়, উনি ছিলেন সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর।
আমার সারাজীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোর একটা – আমি এই শুভ্র শার্টের, শুভ্র মনের মানুষটার ছাত্র ছিলাম । হাজার অপ্রাপ্তি আর ব্যর্থতার মাঝে এই একটা আইডেন্টিটি, আমি কিংবদন্তি জহরলাল স্যারের ছাত্র ছিলাম ।
অসাধারণ। কপি করলাম শেষের কয়টা লাইন।
Sure
পড়ে অনেক ভাল লাগল ভাইয়া। শিক্ষক হিসেবে আমিও কিছু শিখলাম স্যারের আদর্শ থেকে।
Glad that you liked it brother !
অসাধারন লিখেছে বন্ধু ,,,ক্লাসে স্যারের কথাগুলো চোখে ভাসছে
ক্লাসে স্যারের কথাগুলো কি ভোলা যায় বল বন্ধু ?
আসাধরন লিখছিস বন্ধু। স্যার আমাদের গ্রুপে(৩) ক্লাস নেয়ার সময় যে কথাগুলা বলতে ঐগুলা মানে পরে গেল। স্যার এযাবতকালের গনিতের আইন্সটাইন।
Thanks for the kind words dost ^_^
স্যারের আর একটা কথা মনে পড়ে গেল, “রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সহজ কথাটা সহজ ভাবে বলাই, সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার’ ” ।
Yess. i remember that too.
স্যারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এমন মানুষ কয়েক যুগ পরপর একজন আসে।
আর তুই অসাধারণ লিখেছিস।স্যার পড়লে খুব খুশি হবেন
Humbled by the kind words dost !
Thank you so much for writing so beautifully. I was blessed to have him throughout my college life back in NDC.
Thank you so much !
Love and respect from the core of my heart for Sir.
❤
❤
খুব সুন্দর আর্টিকেল লিখেছেন।
Thank you so much
great write up
Thank you so much
very nice article
Thank you
অসাধারণ শিল্পমন্ডিত বর্ননা একজন আলোকিত মানুষের।
তোমাকে আমার প্রান ঢালা অভিনন্দন।
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ