বিতর্ক থেকে শেখা আমার ৫ টি life lesson

Scroll this

ডারউইনের theory of evolution এর বানর থেকে মানুষ বিবর্তিত হবার যে ছবিটা আমরা দেখি – আমার জীবনেও এরকম একটা বিবর্তনের ঘটনা আছে । একদম অন্ধকারে থাকা কুয়োরব্যাঙ  থেকে আলো তে আসার মত,  নিরক্ষরতা  থেকে অক্ষরজ্ঞান লাভ করার মতই একটা পরিবর্তন ঘটে আমার জীবনে  ২০০৯ সালে ।
২০০৯ এর মাঝের দিকে বুয়েটের প্রথম বর্ষে বুয়েট ডিবেটিং ক্লাব এ যোগদান করার মাধ্যমে competitive debating/ প্রতিযোগিতামুলক বিতর্কের সাথে আমার পরিচয় হয় । ছাত্র জীবনের ৫ বছর পাগলের মত বিতর্ক করেছি । নিজের undergrad academic life এ যেই পরিমান পড়াশুনা করেছি তার থেকে ৫ গুন সময় দিয়েছিলাম বিতর্কের পেছনে – কম হইলেও ২ হাজার ঘন্টা প্লাস ।  তখন ভাবতাম এগুলো হয়ত এমনেই ভালোলাগা থেকে করতেছি – পরবর্তী জীবনে এগুলো হয়ত থোরাই কাজে আসবে । আজকে অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি , আমার জীবনের সবচেয়ে transformative effect  ছিল  বিতর্কের । গত এক দশকে আমার জীবনে ছোটবড় প্রাপ্তির পেছনে প্রত্যক্ষ অথবা পরক্ষ ভাবে বিতর্কের বিশাল অবদান ছিল। বিতর্ক আমাকে দুহাত ভরে দিয়েছে। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম এইটা নিয়ে লিখবো । কি শিখলাম আমি বিতর্ক করে ? আজকে লিখবো বিতর্ক থেকে পাওয়া আমার ৫ টি life lesson  নিয়ে :

বিতর্কের  প্রথম lesson হল , Intellectual Curiosity
বিতর্ক করতে গিয়ে দেখলাম,  সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক যেকোন বিষয়েই ১৫ মিনিটের নোটিশে বিতর্ক করতে হবে। সেই সুবাদে  অনেক বিষয় নিয়ে গভীরতর বিশ্লেষণ করতে হতো।  যার  আগে থেকে প্রায় সব ব্যাপারেই যার যত পড়াশুনা থাকবে তার বিতর্কে ভালো করার সম্ভাব্যতা ততই বেশি । বিতর্ক করতে গিয়ে তাই বিভিন্ন তদনিন্তন বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়ে ।     প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস, যেকোনো বিষয়কে একদম ফান্ডামেন্টাল থেকে বুঝতে চাওয়ার প্রবণতা বিতর্ক থেকেই পাওয়া ।
যেকোন বিষয়কে যুক্তির কঠিন কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে তবেই কেবল সঠিক সিদ্ধান্তে অবতীর্ণ হওয়া যায়, এমন একটা ভাবনাকে খুব গভীরভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে শিখেছি  বিতর্ক করতে গিয়ে।
একটা নির্ভেজাল intellectual curiosity তৈরি করেছে বিতর্ক আমার মধ্যে , যেটার দাম আমার  কাছে সহস্র কোটি টাকার থেকেও বেশি   ।  

বিতর্কের  দ্বিতীয়  lesson হল ,  যেকোনো ব্যাপারেই আসলে বিতর্কের অবকাশ আছে।  অকাট্য  সত্য/ভালো কিংবা মিথ্যে/খারাপ খুব কম জিনিসই আছে , বাস্তবে বেশিরভাগ জিনিসই আসলে grey area তে । সত্য ব্যাপারটা প্রায় পুরোটাই আপেক্ষিক , আর কন্টেক্সট নির্ভর ।   তাই  আপনি কিভাবে একটা যুক্তি/reasoning সাজাচ্ছেন সেটাই মূল । যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির মাধ্যমেই কেবল, আমরা  দুইটি অপশন এর মধ্যে তুলনামুলক ভালো অপশনটি বাছতে পারবো । বিতর্ক শিখিয়েছে যে , কোনকিছুকেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে নেই । ভালো-মন্দ যাচাইয়ে আবেগের স্থান নেই, হৃদয়ের সবচেয়ে ভেতরে পালন করে থাকা বিশ্বাসগুলোকেও সময়ে সময়ে প্রশ্ন করে নতুন করে যাচাই করতে শিখিয়েছে বিতর্ক । পেপার-পত্রিকা-বই যেকোনো জায়গায় কোন কিছু লেখা থাকলেই   তা বেদবাক্য হিসেবে  মানা যাবেনা  , সেটা যদি আমার যুক্তির পরীক্ষায় পাশ করে কেবল তবেই সেটা আমি মানতে পারবো  । আপাত দৃষ্টিতে এটা সহজ কাজ মনে হলেও, এই কাজটা আসলে অসম্ভব রকমের কঠিন । অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার নিজের এই জায়গাটায় অনেক  ইম্প্রুভমেন্ট এর স্কোপ আছে  ।  

বিতর্কের তৃতীয় lesson হল , শ্রদ্ধার সাথে আরেকজনের সাথে দ্বিমত পোষণ করা
“It is the mark of an educated mind to be able to entertain a thought without accepting it.” Aristotle.
  একজনের সাথে  সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও যে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায়, তার যুক্তিকে খন্ডন করা যায় এটা আমার কাছে নতুন একটা ব্যাপার ছিল আসলে । যার সাথে মতের মিল হয়না , সেও যে সম্মানপ্রাপ্য- বিতর্ক শিখিয়েছে এই জিনিস । জ্ঞান আর যুক্তির দুনিয়ায় ব্যক্তিগত ইগোর যে কোন স্থান নেই, বিতর্ক না করলে এইটা অনুধাবন করতে পারতামনা  । এই যে বিতর্কের মঞ্চে আমি নিজের মন মত কেস তৈরি করতে পারছি , ১০০% স্বাধীনতায় মুখ ফুটে যেকোন কথা বলতে পারছি – কোনও রকমের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির ভয় ছাড়াই-এই অভিজ্ঞতাটি আমাকে শিখিয়েছে যুক্তি ও জ্ঞান চর্চার প্রকৃত পরিবেশ কিরকম হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য,  বাস্তব জীবনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে এর ১০০% বিপরীত চিত্রটিই দেখি। মতের সাথে সামান্য অমিল হলেই পালা করে সবাই আক্রমন করে – কি বিষাক্ত একটা পরিবেশ ।  স্বপ্ন দেখি,  বিতর্কের পোডিয়াম এর মতই বাস্তব জীবনে আমাদের দেশে এরকম যুক্তিচর্চার সুন্দর শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ তৈরি হবে ।

  বিতর্কের চতুর্থ   lesson হল  , সাহস। মনের কথা নিঃসংকোচে বলতে পাড়ার সাহস । আমার মনে আছে প্রথম বিতর্কের দিন বক্তৃতা দেয়ার সময় ভয়ে আমার পা থরথর করে কাপতেসিল , আর সামনের বেঞ্চে আমার পায়ের ধাক্কা লেগে খুবই শ্রুতিকটু শব্দ হচ্ছিল । সেইদিন থেকে ৫ বছর শত শত রাউন্ড বিতর্ক করার পর, কোথায় যে পালালো সেই ভয় ।    এখন আমি আমার মনের কথা নির্ভয়ে যেকোন মানুষের সামনে বলতে পারি, সে যত বড় ব্যাক্তিই হোক না কেন । এক পরিসংখানে জিগেশ করা হয়েছিল কোন জিনিসটি মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, সেখানে মৃত্যু ছিল দুই নম্বরে- আর জনসম্মুখে কথা বলা ছিল এক নম্বর । এই যে কোটি কোটি মানুষের জনসম্মুখে কথা বলার এত ভয়, এতসব ভীত মানুষের ভিড়ে নির্ভয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে পারাটা  একটা সুপারপাওয়ার ।

 বিতর্কের পঞ্চম   lesson হল  , ফিডব্যাক নিতে শেখা । বিতর্কের শেষে বিচারক ফলাফল ঘোষণা এর সাথে বিতর্কের একটা মুল্যায়ন করে , যেখানে সে ব্যাখ্যা করে প্রতি টিমের যুক্তির আপেক্ষিক শক্তি আর দুর্বলতা । আর এর পরে বিতর্কের রুমের বাহিরে one-to-one বিচারকের কাছ থেকে আরও ডিটেইলে নিজের স্পিচের দুর্বলতাগুলো জেনে নেয় বিতার্কিকেরা । এই যে নিজেকে ইম্প্রুভ করার জন্য প্রতি রাউন্ডে ফীডব্যাক নেয়া, এবং পরের রাউন্ড কিংবা পরের টুর্নামেন্টগুলোতে সেই ভুলগুলো না রিপিট করার যে সুচিন্তিত effort – এইটাই বছরের পর বছর করার পর একজন নবীন বিতার্কিক পরিনত হয় একজন চ্যাম্পিয়ন  বিতার্কিকে । আসলে যেকোন  ফিল্ডেই যারা elite performer , তাদের সবার অনেকটা একই রকমের মূলমন্ত্র ।    

জীবনের শেষ  শেষ বিতর্ক করেছি ২০১৩ সালের নভেম্ভরে, তারপরে বিভিন্ন বিতর্কে বিচারক হিসেবে যাওয়া হতো দু-তিন বছর। বহুবছর ধরে সেটাও যাওয়া হয়না , জীবনের বহুমুখী ব্যস্ততার জন্য । এই ব্যাপারটা আমাকে মাঝে মাঝেই কষ্ট দেয় । আমি এটা মন থেকে বিশ্বাস করি মানুষের আসল মরণ তখন ঘটে যখন তার মস্তিষ্ক জড়বস্তুতে পরিণত হয়, যখন তার intellectual spark টা থাকেনা – যখন সে শুধু বাচার জন্য বাচে। কিন্তু, আমি অনেক দিন বাঁচতে চাই। বিতর্ক থেকে দূরে চলে আসলেও , রক্তে থাকা  বিতর্কের স্পিরিটটাকে মজ্জাগত করে বাচতে চাই।

Tags:

2 Comments

  1. অনেক কিছুই আমার সাথে মিলেছে।
    এখনো যখন কাস্টোমার বা কলিগের সাথে তর্ক বাঁধে, নিজেকে বলি, “বিতর্ক কর, তর্ক নয়।”
    বাকিটা ম্যাজিক!

    • অনেক কিছুই আমার সাথে মিলেছে।
      এখনো যখন কাস্টোমার বা কলিগের সাথে তর্ক বাঁধে, নিজেকে বলি, “বিতর্ক কর, তর্ক নয়।”
      বাকিটা ম্যাজিক!

Submit a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *